লেখক পরিচিতি
ড. নূরুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়ন বিষয়ে বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট ডক্টোরাল। '৭০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রথম সিনেটের সদস্য। ১৯৮০ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস। পেশায় গবেষক-বিজ্ঞানী, বর্তমানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ড. নূরুন নবীর পেটেন্টকৃত আবিষ্কারের বর্তমান সংখ্যা ৫৫। বিজ্ঞানের পেশাদারী জার্নালে এ যাবৎ তাঁর ৫০টি গবেষণা-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি (১৯৬৭-৭১), মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলিতে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রকর্মী, ১৯৭১-এর বীর মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি টাঙ্গাইলের বাঘা সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযােদ্ধা, ফারইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ বর্ণিত টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ‘ব্রেইন’, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য প্রধান সেনাপতি কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্পেশাল সাইটেশন প্রাপ্ত এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ লেখক হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকপ্রাপ্ত ।
SKU: SN
Categories: Dr. Nuran Nabi, Books & Office
ভূমিকা
স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিক পেশার মধ্যে আমার একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। বিজ্ঞানে সফলভাবে শিক্ষকতা এবং গবেষণা করতে হলে উন্নত গবেষণার অভিজ্ঞতা একটি পূর্ব শর্ত। তার জন্য নিজকে প্রস্তুত করতে উন্নত দেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সে সুযোগ পেয়ে গেলাম। জাপানের বৃত্তি। সূর্যোদয়ের দেশ জাপান অনিন্দ্যসুন্দর দেশ। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই দেশ নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষান্বিত সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। জাপানিদের সাফল্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে আমার স্ত্রী বকুল এবং আমার পেশাগত বিষয়, জীববিজ্ঞান-এ জাপানিদের সাফল্য যে কোনো উন্নত দেশের সমকক্ষ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে। তাই আমি জাপানি বৃত্তি লুফে নিলাম।
জাপানে যাওয়ার ঠিক আগের সপ্তাহে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এই অপ্রত্যাশিত জাতীয় ঘটনা আমাদের জাপানে যাওয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং এক পর্যায়ে জাপানে যাওয়ার অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি হয়। যাইহোক, সে জটিলতা কাটিয়ে ১৯৭৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বকুল এবং আমি জাপানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা ত্যাগ করি। আমরা জাপানে পাঁচ বছর কাটিয়েছি। এই সুযোগে জাপানিদের বিশেষত্ব ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। জাপান ৬৮০০টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটি দেশ। এর আর এক নাম নিপ্পন। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তারা তাদের ঐতিহ্য বজায় রেখে দিন দিন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলিকে টেক্কা দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জাপানিরা মেধাবী জাতি, কিন্তু তাদের এই সাফল্য এসেছে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। তারা বিশ্বের ইতিহাসে পরিশ্রমী জাতি হিসেবে স্বীকৃত। জাপানিদের ভোকাবুলারিতে ওভারটাইম শব্দটি নেই। জাপানিরা নিয়মিতভাবে অফিসের সময় শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় কাজ করে। কাজের প্রতি ভালোবাসা তাদের মজ্জাগত, ছোটবেলাতেই এই বিষয়টি তাদের খুব ভালোভাবে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাপানের মানুষ তাই গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করে অফিসে এবং এই অতিরিক্ত খাটুনির ব্যাপারটি নিয়ে তাদের কোনো বিরক্তি বা আক্ষেপ নেই, খুব সাধারণভাবেই তারা বিষয়টি মেনে নেয়।
জাপানিরা বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি অহিংসা এবং শান্তি নিজের জীবনে আত্মস্থ করে তা মেনে চলে। জাপানের সাথে অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির যোগাযোগ স্থাপিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। জাপানিদের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান সফর করেন। এর পর তিনি আরও চারবার জাপানে গিয়েছিলেন। এই ভাবেই অবিভক্ত বাংলার সাথে জাপানিদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সাথে জাপানিদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানিরা বাংলাদেশের সমর্থনে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ ও সাহসিক নেতৃত্ব দেখে জাপানিরা মুগ্ধ হয়েছিল। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা করত। তাঁকে হত্যা করায় জাপানিদের মাঝে বাংলাদেশিদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে মানুষের ইতিহাসের নজিরবিহীন প্রাণহানি ঘটায়। জাপানিরা পরাজয় বরণ করে। আমেরিকা জাপান দখল করে, এবং আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধকালীন জাপানি নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করে জেল ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। জাপানিরা এই অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরিত হয়ে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে এগিয়ে গিয়েছে, এমনকি কিছু কিছু বিষয়ে আমেরিকাকে পিছনে ফেলেছে। আমি এই গ্রন্থে জাপানিদের জীবন এবং সমাজের বিভিন্ন অজানা বিষয়ে আমার উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেছি।
এই গ্রন্থটি রচনা করতে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন আমার জীবনসঙ্গিনী ড. জিনাত নবী, বইটি ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বাঙ্গালীতে প্রকাশ করেছেন সাপ্তাহিক বাঙ্গালীর সম্পাদক কৌশিক আহমেদ এবং বইটি প্রকাশ করেছেন অনন্যা প্রকাশনীর কর্ণধার মনিরুল হক। আমি এই তিনজনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড. নূরুন নবী , মুক্তিযোদ্ধা
একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক
নিউ জার্সি, আমেরিকা